খাদিজা বেঁচে থাক। বেঁচে থেকে জানুক, প্রেমের ক্ষমতা, ছাত্রলীগের ক্ষমতা আর চাপাতির ক্ষমতা একই। খাদিজা বেঁচে থেকে জানুক, পুকুরপাড়ে রক্তের দাগ শুকানোর আগেই ‘বদরুল আমাদের কেউ নয়’ বলে দায় এড়িয়েছে ছাত্রলীগ। খাদিজা বেঁচে থেকে দেখুক, চাপাতি নামক ‘সিরিয়াল কিলার’ কত ভীতিকর বাংলাদেশে। চাপাতির সামনে মানুষ ভয়ে হিম হয়ে যায়, আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচাতে আসার সাহস করে না কেউ। খাদিজারা তা জানুক।
খাদিজা বেঁচে থেকে আরও আরও সম্ভাব্য খাদিজাদের সাবধান করে যাক! খাদিজা বেঁচে থাক, খাদিজা বেঁচে থাক, খাদিজা বেঁচে থাক। এ মুহূর্তে এটাই প্রার্থনা। বদরুলরা হেরে যাক, দায় অস্বীকার হেরে যাক, প্রেমের নামে রক্তবাসনা হেরে যাক। কণিকা, রিসা, নিতুকে বাঁচানো যায়নি, খাদিজা বেঁচে যাক। ত্বকী, তনু, আফসানার হত্যাকারীদের মনে ভয় ধরাতে বদরুলের বিচার হোক।
আফসানার পরিবারের একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয়। আফসানার মা নিহত মেয়ের ছবি দেখছেন। পাশে আফসানার ছোট বোন। ওর মনে কি তখন বোনের মৃত্যুর শোকের পাশাপাশি আফসানার পরিণতির ভয় জেগেছিল? আফসানা ও খাদিজাদের সহপাঠী বোনেরা তো দেশময় ছড়িয়ে আছে। একেকটি হত্যার ঘটনার পর তারা কি আতঙ্ক, ঘৃণা, অসহায়ত্বে মুষড়ে পড়ে না? পরিবারগুলোর মধ্যে নারী-সন্তানকে নিয়ে ভয় তৈরি হয় না? খাদিজা তো দস্যু চোখ, খুনি দৃষ্টি এড়াতে হিজাবে ঢেকেছিল নিজেকে, তবু কি রক্ষা হলো? রক্ষা কি পেয়েছিল তনু? যদি নির্যাতকেরা ক্ষমতাসীন সংগঠনের আশ্রয় পায়, তবে নিজ নিজ মুখ ঢেকে বাঁচা যাবে? যাচ্ছে কি?
বদরুল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। ছাত্রলীগ হওয়ার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করে আসতে পেরেছিলেন তিনি। উত্ত্যক্তকারী বদরুলের চাপাতি বদরুল হয়ে ওঠার ইতিহাস আছে আজ বুধবারের প্রথম আলোর প্রতিবেদনে। ‘২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারিতেও উত্ত্যক্ত করার সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা বদরুলকে ধরে পিটুনি দেন। পরদিন বদরুল তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন জালালাবাদ থানায়। মারধরকারীদের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মামলার এক আসামি প্রথম আলোকে বলেন, উত্ত্যক্ত করার জন্যই যে তাঁকে মারধর করা হয়েছিল, তা সবাই জানত, পুলিশও। তারপরও ২০১২ সালের ৩১ মে ১৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।’
উত্ত্যক্তকারী বদরুলকে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতৃত্বে না বসালে হয়তো চাপাতি বদরুলের জন্ম হতো না। বদরুল চাপাতি বদরুল হতে পেরেছেন প্রশাসন-পুলিশ-দলের অবদানে। ছাত্রলীগ হওয়ার জন্যই বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রী আফসানাকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা রবিন ও তাঁর বন্ধুদের এখনো কিছু হয়নি। তাঁরা আফসানার পরিবারকে ফোন করে হুমকিও দিচ্ছিলেন বিষয়টি ‘মীমাংসা’ করে ফেলার জন্য। সেই মীমাংসা কি হয়ে গেছে? কী মীমাংসা হয়েছিল তনুর হত্যাকারীদের সঙ্গে যে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তই হতে পারল না? এসব জীবন কি খরচযোগ্য ছিল?
নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সীমা বানু সিমি উত্ত্যক্ত করার কারণে ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করেন। ঘটনার ১৫ বছর পার হয়ে গেছে। মামলাটির এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নারীর জীবন সস্তা হয়ে গেছে দেশে? গরিব ও মধ্যবিত্ত কোনো পরিবার কীভাবে ভরসা নিয়ে বাঁচবে? ‘বিচার চাই’ ‘বিচার চাই’ বলে কত চিৎকার করা হয়। ছাত্রসংগঠন করে, মানবাধিকার সংগঠন করে, তনুর মায়েরা রাস্তায় রাস্তায় সভা করে বুকফাটা কান্না করেন; কিছু কি বদলায়?
কোনো কোনো ঘটনার বিচার হয় সত্য। যেমন বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের হয়েছে। কারণ, পুরো দেশ সরব হয়ে উঠেছিল। যখন অপরাধী হয় ক্ষমতার সিঁড়ির নিচের দিকের লোক, তখন বিচারের আশা ধিকিধিকি জ্বলতে পারে। বিচারও হতে পারে। আমরা বিচারহীনতা নিয়ে কথা বলি খুব। হিসাবটা কি এমন, অজস্র খুন হতে থাকবে আর অজস্র বিচারও চলতে থাকবে? কিন্তু হত্যাকাণ্ড ঘটার আগেই, নির্যাতন-ধর্ষণ ঘটার আগে কি কিছুই করার নেই? যদি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার ছাতা মানুষের মাথার ওপর থাকত, তাহলে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যেত। কিন্তু যখন ক্ষমতাসীন সংগঠনই হয়ে পড়ে যাবতীয় দুর্বৃত্তের আখড়া, তখন অপরাধ ঘটার হার বাড়বেই।
ছাত্রলীগ যে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে; তার কারণ এখানে সমবেত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গনের ভরসা হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হয় না। ক্ষমতার খুঁটি ছাত্রলীগ চালাতে ঊর্ধ্বতন নেতাদের দরকার ‘স্ট্রং ম্যান’। এই ‘স্ট্রং ম্যান’দের খায়েশ, আহ্লাদ, লোভ তো থাকবেই। সেসব হাসিল করায় তারা বাধা মানবে কেন? তারা তো স্ট্রং ম্যান। এভাবেই সাধারণ ছেলেরা তেজস্ক্রিয় সংগঠনের সদস্য হয়ে তেজি বদরুল হয়ে ওঠে। চাপাতি হাতে নেয়। হাতটা বদরুল হলেও চাপাতিটা ক্ষমতার।
এত এত অবিচার হয়েছে, তাতে অনেক অনেক বদরুল আশকারা পেয়েছে। এত এত বদরুল পয়দা হয়েছে, অনেক অনেক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়া তারা দমবে না। অনেক ভালোর মাঝে এত এত খারাপ ছাত্রলীগার আছে, বড় মাপের শুদ্ধি অভিযান ছাড়া সমাজ নির্ভয় হ
0 comments:
Post a Comment