চীনা অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল আলোচনা হলো- ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এর মাধ্যমে চীন আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় সংযোগ তৈরি করে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন ধারা সৃষ্টি করতে চায়। চীনের সিল্ক বিশ্ববাজারে এই রাস্তা দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। সে জন্যই এ রাস্তার নাম সিল্ক রোড। বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যে টেকসই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ওই রাস্তাটি নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে চীন। মহাপ্রাচীরের মতো এটা নতুন এক মহাপরিকল্পনা চীনা কমিউনিস্ট রাজনৈতিক এলিটদের। বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র বদলে যাওয়ার আগে এই রুট প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির ভবিষ্যৎকে বদলে দেবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। এতে করে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রগুলোও অনিবার্যভাবে পরিবর্তন আসবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা ভারত-মার্কিন অক্ষের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়বে।
সতেরো ও আঠারো শতকের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার সাথে এর ফারাক রয়েছে। সেটা ছিল অতিরিক্ত রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি জড়ো করার ইউরোপীয় অভিযান। নব উদ্ভাবিত ওয়ান রোড ওয়ান বেল্টের মাধ্যমে নতুন করে চীনাদের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্য দৃশ্যমান হচ্ছে। তাদের এই প্রচেষ্টা বাণিজ্যিক হলেও সেটা গঠনমূলক এবং আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বিধিবিধানের মধ্যে পরিচালিত হওয়ার মনোভাব প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটি পুরোপুরি চীন সরকার পরিচালিত বিশ্বায়ন কৌশল। এর মাধ্যমে এরা নিজেদের জন্য পুঁজি ও সম্পদ জড়ো করতে চাইবে। এর দৃশ্যমান কার্যক্রম হলো উন্মুক্ত বাণিজ্য এলাকা স্থাপন। যেমনটি আশিয়ানের অধীনে ২০১০ সালে শুরু হয়েছে। এটিকে এরা দ্রুততার সাথে দক্ষিণ এশিয়া পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত করতে চায়। সেখান থেকে তাদের পণ্যে সয়লাব করতে চায় ইউরোপকে। অন্য দিকে, আরব সাগর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছা তাদের আপাত লক্ষ্য।
২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন খাতে চীনের উৎপাদন সীমা ছাড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত উৎপাদনকে সিল্ক রোড ব্যবহার করে সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে চায় এরা। বিগত ৩০ বছরে গরিব দেশ থেকে চীন উঠে এসেছে মধ্যম আয়ের দেশে। ধনী দেশ না হয়েও এটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি। একটানা ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমে এসেছে। সীমান্তের প্রদেশগুলো এখনো রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত। অতিরিক্ত উৎপাদনের পণ্যগুলো বিক্রি করে জাতীয় উন্নয়নের খুঁতগুলোকে মেটাতে চায় এর মাধ্যমে চীন। বাণিজ্যিক প্রাধান্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল চীনের অভ্যন্তরীণ উন্নতি ত্বরান্বিত করাই কি চীনের একমাত্র লক্ষ্য? না এর পেছনে রয়েছে ভিন্ন আরো মতলব। সিল্ক রোড তৈরির মোটিভ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণে এর মধ্যে ভাগ বসিয়েছে রাশিয়া। চীনা প্রভাব এমনভাবে উঠে আসছে যে, বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনকেও তাদের জায়গা করে দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে আঞ্চলিক আরো কয়েকটি দেশ প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে।
চীনের অতিরিক্ত উৎপাদনে অবশম্ভাবী ছড়িয়ে পড়া বিশ্বে বিকল্প রাজনীতির জন্ম দেবে। এই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানে ৪৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে চীনের সীমান্ত থেকে পাকিস্তানের গোয়াদরে বাণিজ্যিক পণ্য পৌঁছে যাবে এক দিনে। কারাকোরাম হয়ে মধ্য এশিয়ায় তাদের পণ্য পৌঁছাতে সামান্য কিছু বেশি সময় লাগবে। নতুন সিল্ক রোড নিঃসন্দেহে বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দেবে। সৃষ্টি হবে নতুন বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাও। চীন স্রেফ অভ্যন্তরীণ উন্নতির জন্য ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট প্রকল্প এগিয়ে নিলেও এটি তাদের বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি জোগাবে।
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাকিস্তান সফরে ৪৬০০ কোটি ডলারের এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক উচ্ছ্বসিত বক্তব্যে বলেন, এতে করে শুধু পাকিস্তানের ২০ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নয়, উপকৃত হবে এশিয়ার ৩০০ কোটি মানুষ। এর আওতায় সরাসরি কাজ পাবে পাকিস্তানের সাত লাখ মানুষ। চীনের সীমান্ত থেকে বেলুচিস্তানের গোয়াদর পর্যন্ত সংযোগ উন্নয়নকার্যক্রমের বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। একে এরা নাম দিয়েছে চীন-পাকিস্তান করিডোর উন্নয়ন। এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিস্তৃত রূপরেখা কার্যকর হতে শুরু করলে পাকিস্তানের জাতীয় আয় গড়ে আড়াই শতাংশের বেশি বেড়ে যাবে। ওই সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সাথে ৫১ দফার সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। জ্বালানি, অবকাঠামো, নিরাপত্তাসহ আরো ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কিভাবে অর্থ ব্যয় হবে তার একটি খসড়া রোডম্যাপ ছিল ওই স্মারকে। মোটা দাগে ৩৪০০ কোটি ডলার খরচ হবে জ্বালানি খাতে ও ১২০০ কোটি ডলার খরচ হবে অবকাঠামো খাতে। এর আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হবে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান আর্মির একটি বিশেষ ডিভিশন থাকবে উন্নয়নকর্ম পাহারা দেয়ার জন্য। একজন মেজর জেনারেলের নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্য থাকবে ওই ডিভিশনে। বিশেষত বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত বেলুচিস্তানে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের মূল কাজে নিরাপত্তা দেবে এরা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ নিমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিকস সম্মেলনের সাইড লাইনে মোদির সাথে বৈঠক করবেন। অন্য দিকে, ব্রিকস সম্মেলনে যাওয়ার পথে মধ্য অক্টোবরে শি জিনপিং দুই দিনের সফর করবেন বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সফর করার শিডিউল দিতে পারেন না। সেই দেশের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর বিরল। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারত সফরের পথে যেন বাংলাদেশে উঁকি মেরে গেলেন। সেখানে চীনা প্রেসিডেন্টের দুই দিনের সফর বেশ আগ্রহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। মোদির সাথে সক্ষাতের আগে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ হাসিনার বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উপমহাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ কোন কোন খাতে চীন বিনিয়োগ করতে পারে, এমন তালিকা এরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে চেয়ে আসছিল। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন চীনা এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশে নমনীয় সুদে ২৩০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রাথমিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০টি প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ হতে ২০২০ সালের মধ্যে এর বাস্তবায়ন হবে বলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের বিনিয়োগের আকারটি এর কাছাকাছি কিংবা এর চেয়ে কম হলেও বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তা বিপুল বলতে হবে।
সহায়তাকার্যক্রমের আকার নেপালেও অনেক বাড়িয়েছে চীন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেপালে বিদেশী বিনিয়োগের ৪২ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। এককভাবে কেউ এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ সেখানে করেনি। দানের ক্ষেত্রে দেশটিতে চীনারা সবার চেয়ে এগিয়ে গেছে। ২০১০-১১ সালে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে এরা ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী ভারত ২০১৪-১৫ সালে যখন দুই কোটি ডলারের কিছু বেশি অনুদান দেয় তখন দেশটিতে চীনাদের অনুদান দ্বিগুণ বেড়ে প্রায় চার কোটি ডলার পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। নেপালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থনে প্রণীত সংবিধানকে বাধাগ্রস্ত করে নাগরিকদের নগণ্য একটি অংশ। ক্ষুদ্র অংশটিকে সমর্থন করে ভারত দেশটিতে অনেকটা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে।
ওই অবরোধে নেপালের জন্য সবচেয়ে বিপদের কারণ হয় জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায়। জ্বালানির জন্য দেশটি পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সঙ্কট কাটাতে দেশটি চীনের দ্বারস্থ হয়। চীন তাদের হতাশ করেনি। জ্বালানি সরবরাহে চীনাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হতে চলেছে। বড় বড় আরো কয়েকটি প্রকল্পে চীন অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, ড্যাম নির্মাণ অত্যাধুনিক বিমানবন্দর স্থাপনে অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন। এতে করে ভারতের ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীলতার দিন শেষ হতে চলেছে। অর্থনৈতিক সহায়তার বিপরীতে নেপালের কাছ থেকে ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট মহাপ্রকল্পে সম্মতি নিয়েছে চীন। বৌদ্ধের জন্মস্থান নেপালের লুম্বিনিতে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় তিন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। এতে লাখ লাখ বৌদ্ধ ভক্ত আগমন ঘটবে। পর্যটন শিল্পে আকার বেড়ে গিয়ে নেপালি অর্থনীতিতে নতুন দিনের সূচনার প্রহর গুনছে।
চীনা সহায়তা নেপালি জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল নেপালে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা ছাড়িয়ে দক্ষিণের সমতলের মানুষ শুনতে পায়। রেডিও স্টেশনটি নেপালে কতটা জনপ্রিয় পাঠকদের সাড়া থেকে অনুমান করা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পাঠকেরা নেপালের সঙ্কট সমাধানে চীনকে সাহায্য করার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে স্টেশনটি এ ধরনের কয়েক হাজার হাতে লেখা চিঠি পাচ্ছে। রাজতন্ত্রের পতনের পর চীন তাদের কূটনীতিক উদ্যোগ বাড়িয়েছে নেপালে। সেখান রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক শ্রেণীর সাথে তারা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার সাথে চীনাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত। মাহিন্দ রাজাপাকসে নামে শ্রীলঙ্কার বৃহৎ সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এশিয়ার অন্যতম বন্দর হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আরেকটি বন্দর সেখানে নির্মাণের জন্য প্রস্তাবে রয়েছে। সেই বন্দর নির্মাণের সহায়তা করবে চীন।
চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ দক্ষিণ এশিয়ার সাথে জোরদার হচ্ছে। সেই সময় এ অঞ্চলের বড় দেশ ভারতের সাথে প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা মাত্রায় বিরোধ প্রকাশ পাচ্ছে। কাশ্মিরের উত্তেজনা থেকে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধংদেহি মনোভাব বিরাজ করছে। উন্নয়নের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার বদলে বৈরিতার উসকানি প্রাধান্য পাচ্ছে উপমহাদেশে। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা না গেলেও পারস্পরিক শত্রুতা বেগবান করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে অভিন্ন নদীর পানি ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি অভিন্ন নদীর পানি অনেক আগে থেকে ভারত উজানে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে একচেটিয়া। মানুষের ধারণা বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকেও ন্যায্য পানির হিস্যা দিত ভারত। পাক-ভারত শক্তির ভারসাম্য থাকায় পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা যাচ্ছে না এমনটাই মানুষের ধারণা।
বাংলাদেশের নৌপথ রাজপথ ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে ভারত। এতে করে পূর্বাঞ্চলের সাথে ভারতের বড় ভূখণ্ডের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। মালামাল পরিবহনে সময় ও অর্থ বেঁচে যাচ্ছে তাদের। নিরাপত্তাব্যয়ও এতে সাশ্রয় হবে। কিন্তু মাশুল পরিশোধে দেশটি উদারতা দেখাতে পারছে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষের একটা ধারণা, ভারত না চাইতেই সব কিছু দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে সঙ্কীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তারা জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিবর্তে বিশেষ রাজনৈতিক দল ও কায়েমি স্বার্থবাদী কিছু সুযোগসন্ধানীকে বন্ধুত্বের জন্য বেছে নেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য গণতন্ত্রকে তারা চায়নি। তারা চেয়েছে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকুক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিছু স্বার্থবাদী, বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়ার সাথে একতরফা সম্পর্ক গড়ে কৌশলে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে ভারত এমন মনোভাব মানুষের মধ্যে রয়েছে।
একই ধরনে সীমাবদ্ধ স্বার্থের প্রতিফলন দেখা গেছে প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপের সাথেও। ভারত সেখানে বরাবর নিজেদের চয়েসকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। জনগণের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির চেয়ে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক করে অবনত করে রাখার চেষ্টা ক্ষোভ হিংসা বাড়াচ্ছে। যেমনটা নেপালের ক্ষেত্রে ঘটে এসেছে। শ্রীলঙ্কাও একই ধরনের মনোভাবের শিকার হয়েছে। এ অবস্থায় চীনা অর্থনীতির উপচে পড়া জোয়ার দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে চীনা সাহায়তা ও বিনিয়োগের প্লাবন এ অঞ্চলের মানুষকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার উৎসাহ জোগাবে বেশি মাত্রায়। সে জন্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে বিশেষ সম্পর্ক করার জন্য চীনের চেষ্টা নিতে হবে না। ভারতের উচিত একচোখা নীতি থেকে সরে এসে অত্র অঞ্চলের জনগণ নির্বিশেষে সম্পর্ক গড়ে তোলা। সমতা ভ্রাতৃত্বের নীতি গ্রহণ করে ভারতও চীনের সাথে উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে। অন্যথায় একপর্যায়ে এসে চীনা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অনিবার্য চাপে পিষ্ট হতে পারে ভারত।
বিস্তারিত আরো জানতে নিচে ক্লিক
করুন
সতেরো ও আঠারো শতকের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার সাথে এর ফারাক রয়েছে। সেটা ছিল অতিরিক্ত রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি জড়ো করার ইউরোপীয় অভিযান। নব উদ্ভাবিত ওয়ান রোড ওয়ান বেল্টের মাধ্যমে নতুন করে চীনাদের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্য দৃশ্যমান হচ্ছে। তাদের এই প্রচেষ্টা বাণিজ্যিক হলেও সেটা গঠনমূলক এবং আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বিধিবিধানের মধ্যে পরিচালিত হওয়ার মনোভাব প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটি পুরোপুরি চীন সরকার পরিচালিত বিশ্বায়ন কৌশল। এর মাধ্যমে এরা নিজেদের জন্য পুঁজি ও সম্পদ জড়ো করতে চাইবে। এর দৃশ্যমান কার্যক্রম হলো উন্মুক্ত বাণিজ্য এলাকা স্থাপন। যেমনটি আশিয়ানের অধীনে ২০১০ সালে শুরু হয়েছে। এটিকে এরা দ্রুততার সাথে দক্ষিণ এশিয়া পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত করতে চায়। সেখান থেকে তাদের পণ্যে সয়লাব করতে চায় ইউরোপকে। অন্য দিকে, আরব সাগর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছা তাদের আপাত লক্ষ্য।
২০০৬ সাল থেকে বিভিন্ন খাতে চীনের উৎপাদন সীমা ছাড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত উৎপাদনকে সিল্ক রোড ব্যবহার করে সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে চায় এরা। বিগত ৩০ বছরে গরিব দেশ থেকে চীন উঠে এসেছে মধ্যম আয়ের দেশে। ধনী দেশ না হয়েও এটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি। একটানা ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমে এসেছে। সীমান্তের প্রদেশগুলো এখনো রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত। অতিরিক্ত উৎপাদনের পণ্যগুলো বিক্রি করে জাতীয় উন্নয়নের খুঁতগুলোকে মেটাতে চায় এর মাধ্যমে চীন। বাণিজ্যিক প্রাধান্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল চীনের অভ্যন্তরীণ উন্নতি ত্বরান্বিত করাই কি চীনের একমাত্র লক্ষ্য? না এর পেছনে রয়েছে ভিন্ন আরো মতলব। সিল্ক রোড তৈরির মোটিভ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণে এর মধ্যে ভাগ বসিয়েছে রাশিয়া। চীনা প্রভাব এমনভাবে উঠে আসছে যে, বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনকেও তাদের জায়গা করে দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে আঞ্চলিক আরো কয়েকটি দেশ প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে।
চীনের অতিরিক্ত উৎপাদনে অবশম্ভাবী ছড়িয়ে পড়া বিশ্বে বিকল্প রাজনীতির জন্ম দেবে। এই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানে ৪৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে চীনের সীমান্ত থেকে পাকিস্তানের গোয়াদরে বাণিজ্যিক পণ্য পৌঁছে যাবে এক দিনে। কারাকোরাম হয়ে মধ্য এশিয়ায় তাদের পণ্য পৌঁছাতে সামান্য কিছু বেশি সময় লাগবে। নতুন সিল্ক রোড নিঃসন্দেহে বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দেবে। সৃষ্টি হবে নতুন বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থাও। চীন স্রেফ অভ্যন্তরীণ উন্নতির জন্য ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট প্রকল্প এগিয়ে নিলেও এটি তাদের বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি জোগাবে।
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাকিস্তান সফরে ৪৬০০ কোটি ডলারের এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক উচ্ছ্বসিত বক্তব্যে বলেন, এতে করে শুধু পাকিস্তানের ২০ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নয়, উপকৃত হবে এশিয়ার ৩০০ কোটি মানুষ। এর আওতায় সরাসরি কাজ পাবে পাকিস্তানের সাত লাখ মানুষ। চীনের সীমান্ত থেকে বেলুচিস্তানের গোয়াদর পর্যন্ত সংযোগ উন্নয়নকার্যক্রমের বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। একে এরা নাম দিয়েছে চীন-পাকিস্তান করিডোর উন্নয়ন। এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিস্তৃত রূপরেখা কার্যকর হতে শুরু করলে পাকিস্তানের জাতীয় আয় গড়ে আড়াই শতাংশের বেশি বেড়ে যাবে। ওই সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সাথে ৫১ দফার সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। জ্বালানি, অবকাঠামো, নিরাপত্তাসহ আরো ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কিভাবে অর্থ ব্যয় হবে তার একটি খসড়া রোডম্যাপ ছিল ওই স্মারকে। মোটা দাগে ৩৪০০ কোটি ডলার খরচ হবে জ্বালানি খাতে ও ১২০০ কোটি ডলার খরচ হবে অবকাঠামো খাতে। এর আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হবে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান আর্মির একটি বিশেষ ডিভিশন থাকবে উন্নয়নকর্ম পাহারা দেয়ার জন্য। একজন মেজর জেনারেলের নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্য থাকবে ওই ডিভিশনে। বিশেষত বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত বেলুচিস্তানে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের মূল কাজে নিরাপত্তা দেবে এরা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ নিমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিকস সম্মেলনের সাইড লাইনে মোদির সাথে বৈঠক করবেন। অন্য দিকে, ব্রিকস সম্মেলনে যাওয়ার পথে মধ্য অক্টোবরে শি জিনপিং দুই দিনের সফর করবেন বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সফর করার শিডিউল দিতে পারেন না। সেই দেশের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর বিরল। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারত সফরের পথে যেন বাংলাদেশে উঁকি মেরে গেলেন। সেখানে চীনা প্রেসিডেন্টের দুই দিনের সফর বেশ আগ্রহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। মোদির সাথে সক্ষাতের আগে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ হাসিনার বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উপমহাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ কোন কোন খাতে চীন বিনিয়োগ করতে পারে, এমন তালিকা এরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে চেয়ে আসছিল। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন চীনা এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশে নমনীয় সুদে ২৩০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রাথমিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০টি প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ হতে ২০২০ সালের মধ্যে এর বাস্তবায়ন হবে বলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের বিনিয়োগের আকারটি এর কাছাকাছি কিংবা এর চেয়ে কম হলেও বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তা বিপুল বলতে হবে।
সহায়তাকার্যক্রমের আকার নেপালেও অনেক বাড়িয়েছে চীন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেপালে বিদেশী বিনিয়োগের ৪২ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। এককভাবে কেউ এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ সেখানে করেনি। দানের ক্ষেত্রে দেশটিতে চীনারা সবার চেয়ে এগিয়ে গেছে। ২০১০-১১ সালে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে এরা ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী ভারত ২০১৪-১৫ সালে যখন দুই কোটি ডলারের কিছু বেশি অনুদান দেয় তখন দেশটিতে চীনাদের অনুদান দ্বিগুণ বেড়ে প্রায় চার কোটি ডলার পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। নেপালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিরঙ্কুশ সমর্থনে প্রণীত সংবিধানকে বাধাগ্রস্ত করে নাগরিকদের নগণ্য একটি অংশ। ক্ষুদ্র অংশটিকে সমর্থন করে ভারত দেশটিতে অনেকটা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে।
ওই অবরোধে নেপালের জন্য সবচেয়ে বিপদের কারণ হয় জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায়। জ্বালানির জন্য দেশটি পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সঙ্কট কাটাতে দেশটি চীনের দ্বারস্থ হয়। চীন তাদের হতাশ করেনি। জ্বালানি সরবরাহে চীনাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হতে চলেছে। বড় বড় আরো কয়েকটি প্রকল্পে চীন অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, ড্যাম নির্মাণ অত্যাধুনিক বিমানবন্দর স্থাপনে অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন। এতে করে ভারতের ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীলতার দিন শেষ হতে চলেছে। অর্থনৈতিক সহায়তার বিপরীতে নেপালের কাছ থেকে ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট মহাপ্রকল্পে সম্মতি নিয়েছে চীন। বৌদ্ধের জন্মস্থান নেপালের লুম্বিনিতে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় তিন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। এতে লাখ লাখ বৌদ্ধ ভক্ত আগমন ঘটবে। পর্যটন শিল্পে আকার বেড়ে গিয়ে নেপালি অর্থনীতিতে নতুন দিনের সূচনার প্রহর গুনছে।
চীনা সহায়তা নেপালি জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল নেপালে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা ছাড়িয়ে দক্ষিণের সমতলের মানুষ শুনতে পায়। রেডিও স্টেশনটি নেপালে কতটা জনপ্রিয় পাঠকদের সাড়া থেকে অনুমান করা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পাঠকেরা নেপালের সঙ্কট সমাধানে চীনকে সাহায্য করার আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে স্টেশনটি এ ধরনের কয়েক হাজার হাতে লেখা চিঠি পাচ্ছে। রাজতন্ত্রের পতনের পর চীন তাদের কূটনীতিক উদ্যোগ বাড়িয়েছে নেপালে। সেখান রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক শ্রেণীর সাথে তারা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার সাথে চীনাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত। মাহিন্দ রাজাপাকসে নামে শ্রীলঙ্কার বৃহৎ সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এশিয়ার অন্যতম বন্দর হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আরেকটি বন্দর সেখানে নির্মাণের জন্য প্রস্তাবে রয়েছে। সেই বন্দর নির্মাণের সহায়তা করবে চীন।
চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ দক্ষিণ এশিয়ার সাথে জোরদার হচ্ছে। সেই সময় এ অঞ্চলের বড় দেশ ভারতের সাথে প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা মাত্রায় বিরোধ প্রকাশ পাচ্ছে। কাশ্মিরের উত্তেজনা থেকে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধংদেহি মনোভাব বিরাজ করছে। উন্নয়নের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার বদলে বৈরিতার উসকানি প্রাধান্য পাচ্ছে উপমহাদেশে। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা না গেলেও পারস্পরিক শত্রুতা বেগবান করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে অভিন্ন নদীর পানি ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদি। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি অভিন্ন নদীর পানি অনেক আগে থেকে ভারত উজানে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে একচেটিয়া। মানুষের ধারণা বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকেও ন্যায্য পানির হিস্যা দিত ভারত। পাক-ভারত শক্তির ভারসাম্য থাকায় পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা যাচ্ছে না এমনটাই মানুষের ধারণা।
বাংলাদেশের নৌপথ রাজপথ ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে ভারত। এতে করে পূর্বাঞ্চলের সাথে ভারতের বড় ভূখণ্ডের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। মালামাল পরিবহনে সময় ও অর্থ বেঁচে যাচ্ছে তাদের। নিরাপত্তাব্যয়ও এতে সাশ্রয় হবে। কিন্তু মাশুল পরিশোধে দেশটি উদারতা দেখাতে পারছে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষের একটা ধারণা, ভারত না চাইতেই সব কিছু দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে সঙ্কীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তারা জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিবর্তে বিশেষ রাজনৈতিক দল ও কায়েমি স্বার্থবাদী কিছু সুযোগসন্ধানীকে বন্ধুত্বের জন্য বেছে নেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য গণতন্ত্রকে তারা চায়নি। তারা চেয়েছে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকুক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিছু স্বার্থবাদী, বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়ার সাথে একতরফা সম্পর্ক গড়ে কৌশলে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে ভারত এমন মনোভাব মানুষের মধ্যে রয়েছে।
একই ধরনে সীমাবদ্ধ স্বার্থের প্রতিফলন দেখা গেছে প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপের সাথেও। ভারত সেখানে বরাবর নিজেদের চয়েসকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। জনগণের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির চেয়ে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক করে অবনত করে রাখার চেষ্টা ক্ষোভ হিংসা বাড়াচ্ছে। যেমনটা নেপালের ক্ষেত্রে ঘটে এসেছে। শ্রীলঙ্কাও একই ধরনের মনোভাবের শিকার হয়েছে। এ অবস্থায় চীনা অর্থনীতির উপচে পড়া জোয়ার দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে চীনা সাহায়তা ও বিনিয়োগের প্লাবন এ অঞ্চলের মানুষকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার উৎসাহ জোগাবে বেশি মাত্রায়। সে জন্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে বিশেষ সম্পর্ক করার জন্য চীনের চেষ্টা নিতে হবে না। ভারতের উচিত একচোখা নীতি থেকে সরে এসে অত্র অঞ্চলের জনগণ নির্বিশেষে সম্পর্ক গড়ে তোলা। সমতা ভ্রাতৃত্বের নীতি গ্রহণ করে ভারতও চীনের সাথে উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে। অন্যথায় একপর্যায়ে এসে চীনা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অনিবার্য চাপে পিষ্ট হতে পারে ভারত।
0 comments:
Post a Comment