Tuesday, October 04, 2016

প্রতিভাসচেতন বাবা-মা এবং উপযুক্ত পরিবেশ

প্রতিভাসচেতন বাবা-মা এবং উপযুক্ত পরিবেশ
 ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ বাক্যটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুর দিকে প্রথম শুনতে পাই। মনে হতো—সকল শিশুরই বাবা হয়তো শিশুদের মনের ভেতরে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্ত কখনো কোনো প্রশ্ন জাগেনি— কই, কীভাবে ঘুমিয়ে আছে?

বীজ থেকে চারা গজালেই যেমন ফলন আশা করা যায় না, তেমনি মানুষ ভ্রূণ থেকে মুক্তি লাভের পরপরই তার বিচক্ষণতা প্রকাশ পায় না। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই বিচক্ষণতা ও অন্যসব ছোট-বড় দক্ষতা ও গুণের সৃষ্টি, উপলক্ষ্য ও প্রয়োগক্ষেত্রের উপযুক্ততার আবির্ভাব ঘটে পর্যায়ক্রমে। কোনো ব্যক্তি যখন একজন পরিপূর্ণ মানুষ ও বিশ্ব নাগরিকে রূপ নেয় তখন তাকে নির্দিষ্ট একটি পথ অতিক্রম করে আসতে হয়। এই পথটিকে কাঠামোগত একটি রূপ দিতে গিয়ে অধিকাংশ গবেষকই গঠনটি দাঁড় করেছেন এভাবে—মাতৃকোল > পরিবার > পরিবেশ > শিক্ষা প্রতিষ্ঠান > সমাজ > বিশ্বসমাজ। যদিও এই পথের ‘বিশ্বসমাজ’টি শুধু তার জন্য যে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় তবুও এ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রতেকেরই দরকার। মানুষ এই পথে জন্মলগ্ন থেকে ধাপে ধাপে আগ্রহ নিয়ে যদি একটু একটু করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগোতে থাকে তবে সমাজ ও দেশ বা বিশ্বসমাজে যে কেউই সুন্দর একটি অবস্থানে থাকতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মাতৃকোল থেকেই উপযুক্ত পরিবেশের আনুকূল্যে মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে।

একটি শিশু প্রথমেই অনুকরণ করে তার মাকে, এরপর পরিবারের অন্য সদস্যদের আচার-আচরণ শিশুর ভেতর প্রোথিত হতে থাকে, ধীরে ধীরে জন-পরিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জনের সাথে মিশে তাদের থেকেও অনেক কিছুই আত্মস্থ করে থাকে ক্রমাচারবর্ধমান এই শিশু। একটি শিশুর বিকাশ ও অবনতিতে পরিবার ও পরিবেশ সর্বাপেক্ষা বেশি এবং কার্যকরী ভূমিকা রাখে। দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি কোনো নেতিবাচক দিক শিশুর মগজে প্রোথিত হয়ে থাকলে পরবর্তীতে ভিন্ন অথচ সুস্থ একটি পরিবেশ পেলে সে সঠিকটি বেছে নিতে পারে। আবার পরিবার থেকে উত্কৃষ্ট কিছু হূদয়ঙ্গম করলেও অসুস্থ পরিবেশের স্পর্শে তা উবে যেতে পারে।

শিশুবেলা থেকে আয়ত্ত করা সামগ্রিক আচরণ, বোধশক্তি, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানবিক চেতনা ইত্যাদি মানুষের জীবনে অদৃশ্য অথচ স্থায়ী উপাদান যা নিয়েই একটি মানুষকে আমৃত্যু পৃথিবীতে থাকতে হয়। উন্নত বিশ্বের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় সেখানে দশ বছরের চেয়েও কম বয়সের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের চেষ্টায়ই কিছু না কিছু করছে এবং তা থেকে তারা ভালই আয় করছে, যা আমরা বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ও সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারি। যদিও এর সংখ্যাটি খুবই নগণ্য কিন্তু এটি সত্য যে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে কারো বয়স ১৪ বা এর কিছু বেশি হলেই তারা বিভিন্ন রকমের কাজে লেগে পড়ে বা কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কারণ তাদের উদ্দেশ্যই হলো স্বাবলম্বী হওয়া তাছাড়া ওসব দেশের মানব সংস্কৃতিটাই এরকম যে, আত্মনির্ভরশীল হওয়া একটি প্রতিযোগিতার মতো হয়ে গেছে। এর ঠিক উল্টো পরিস্থিতি দেখা যায় বাংলাদেশে। বাবা-মায়ের চোখে আমরা যুবক-যুবতী শ্রেণির সন্তানরাও এখনো অবুঝ শিশু! তারা সন্তানের একান্ত নিজের কাজটিও করে দিয়ে থাকেন। বই গোছানো, পড়ার টেবিল ঠিক রাখা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাগ ঠিক-ঠাক করে রাখা, পোশাক-আশাক ঠিক রাখা, সন্তানদের খাবার নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়াসহ ইত্যাদি কাজ বাবা-মায়ের সন্তুষ্ট চিত্তেই করে থাকেন—যা তাদের, আমাদের, সমাজ ও দেশের জন্য একটি গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে না।  প্রত্যেক বাবা-মা’ই তার সন্তানকে আদর স্নেহে মানুষ করে থাকেন—যা সন্তানের জন্যও এক রকমের পাওনা হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু এই আদর-স্নেহ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় তখনই ঘটে বিপত্তি। সন্তানরাও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে না বা কাজের প্রতি লজ্জার পর্দা পড়ে যায়। নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট কিংবা বড় কাজে হাত দিলেও তারা তা থেকে সন্তানের গুটিয়ে নিতে তাগিদ দেয়—‘খবরদার! এসব তুমি পারবে না বাবা, ছেড়ে দাও এসব। প্রয়োজনবোধে আমিই করে দেবে।’

কর্মক্ষম কোনো যুবককে যখন এভাবে কাজের জন্য নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়ে থাকেন তার অতি নিকটের মানুষেরা তখন তার জন্য এর চেয়ে আর বড় কী অভিশাপ থাকতে পারে? এটিও কি বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ নয়? আমরা শুধু অন্যের সৃষ্ট কর্মক্ষেত্রে কর্মের অভাব দেখছি, কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির আগ্রহ দেখাচ্ছি না বা কর্মক্ষেত্রে কর্মের এবং উপযুক্ত কর্মীর অভাব বা বেকারত্বের মূল কারণটিও উদ্ঘাটন না করে সামনে যা দেখছি তা নিয়ে গলা ফাটাচ্ছি।

প্রত্যেক শিশুর মনের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা পিতা নামক প্রতিভাকে জেগে ওঠার সুযোগ দিতেই হবে। কখনো পিতা নিজে থেকেই জাগ্রত হয়, আবার কখনো তাকে জাগিয়ে দিতে হয়। জাগ্রত কোনো পিতা বা প্রতিভা যখন পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ে তখন এর দায়ভার সম্পূর্ণই সমাজ সংশ্লিষ্ট সকলের, এটি কোনো ব্যক্তিক বিষয় নয়। দেশকে কর্মক্ষমতাহীন লোকসমাজ, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য নামের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই শিশু, কিশোর ও যুবকদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ‘পিতা’ বা ‘প্রতিভা’কে জাগ্রত করে তুলতে হবে এবং জাগ্রত প্রতিভা যেন কোনোক্রমেই ঘুমিয়ে না পড়তে পারে সেদিকে সমাজ সংশ্লিষ্ট সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং নিজেদের ভেতর নতুন নতুন কর্মের উদ্দীপনা সঞ্চার করতে হবে—যা দশ ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক। সঙ্গে প্রতিভাসচেতন বাবা-মায়েদেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে জাতি।

আরো খবর জানতে ক্লিক করুন

কেনা-বেচা করতে ক্লিক করুন

Location: Bangladesh

0 comments:

Post a Comment